কারিকুলাম ২০২৩

নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নিয়া ক্ষেপছে দেশের অভিভাবকেরা, সুশীল জনগন। বেশ অনেকদিন যাবত বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নিয়া হাজার-হাজার পোষ্ট, কমেন্ট। যাদের মধ্যে শিক্ষিত, উচ্চ শিক্ষিতও আছেন, আছেন স্কুলের শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর পর্যন্ত। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারও।
অভিযোগ ও ভাবনা : শতশত অভিযোগ কারিকুলামের বিরুদ্ধে। ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা ভুলে যাচ্ছে, কোন লেখাপড়া নাই, আলুভাজি করা, ভাত রান্না করা, বাবুর্চি তৈরির শিক্ষা, কাগজ কাটাকাটি, বহু টাকা খরচ প্রজেক্ট তৈরিতে, গুগল দেখে অ্যাসাইনমেন্ট করা, বাচ্চারা ডিভাইসের প্রতি আসক্ত হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
যাদের বাচ্চাদের মেধা কম মানে মুখস্ত করার বা পড়া দীর্ঘসময় ধারণ করার ক্ষমতা কম এরকম ব্যকবেঞ্চার শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরাই এই মেরুদন্ড ভাঙা কারিকুলামের পক্ষে।
শিক্ষকরা ভুল মূল্যায়ন করছেন। (সেটা কি কারিকুলামের দোষ?)
একজন বলেছেন : নতুন নিয়মের শিক্ষা কারিকুলাম ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল গুলাতেও চালু করা হোক। এগুলাও আমাদের দেশের ভিতরের স্কুল কোনো বাইরের দেশের না।
(ইংলিশ মিডিয়াম ও-লেভেল/এ-লেভেল কোন শিক্ষা বোর্ডের অধীনে?)
আলুভর্তা এখন সেলিব্রেটি।
আলুভর্তাটাই আপনাদের চোখে পড়লো নাকি এটাকেই আপনাদের দেখানো হচ্ছে? সুন্দর মোড়কে কোন কিছু উপস্থাপন করে।
কাউকে যদি জিজ্ঞেস করি, ভাল মোবাইল কোনটি?
সবাই বলবেন iPhone.
কিন্তু, আই-ফোন কেন ভালো কয়জনে বলতে পারবেন? কি কি কারণে আইফোন সেরা?
দরকার কী তা জানার? সবাই ভালো বলে, সেজন্য ভালো।
আরো কম দামের ভিতর কোন মোবাইল?
Samsung, Xiaomi, Vivo Oppo?
কেন? কারণ ব্রান্ড।
আমার কাছে অনেকে পরামর্শ চায়, তাদের সন্তানের জন্য ল্যাপটপ কিনবে। টাকা বিষয় না । ভালোটা চাই।
কোর-আই-5/7। কোন কোম্পানীর কিনবে? কোর-আই-5 কেন?
ওটা ভাল সেজন্য।
টাকা বেশি হলে যে প্রোডাক্ট ভালো সেটা আপনাদের কে বলছে?
ক্যামেরা ভালো কোনটা? মেগাপিক্সেল বেশি যেটা।
Samsung, Apple এর ক্যামেরার মেগাপিক্সেল অন্যগুলোর চেয়ে কম হওয়া সত্বেও ছবির কোয়ালিটি ভালো হয় কেন তাহলে?
সঠিক উত্তরটা দিতে পারবেন না অনেকেই।
তারপরেও কোন কিছু না জেনে কোন বিষয়ে মতামত দিতে আমরা সবসময় এগিয়ে।
ডাক্তারিও করি আমরা।
কেনরে ভাই, যা বুঝোসনা, সেটা নিয়া মন্তব্য করার মতো পাক্নামি করা কেন?
বর্তমানের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়া আন্দোলনের কারণও একই রকম বলে মনে করি।
না বুইঝাই মাতামাতি।
আমার মনে হয়, এই শিক্ষা ব্যবস্থা কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহলকে চটেপোঘাত করেছে। যার জন্য তারা অভিভাবকদের ভুল বুঝাচ্ছে। উস্কাচ্ছে।
নিচে যাওয়ার আগে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়া দালালি করার জন্য একটা গালি দেন মনে মনে।
তারপরর আসেন শুরু করি।


আলুভর্তা :
আলুভর্তা বানানো জানাটা কি খারাপ? শিক্ষার্থীদের পঠিত দশটি বিষয়ের একটি বিষয় জীবন ও জীবিকা। তার একটি অধ্যায়ের একটা অংশ স্কিল কোর্স। যার ২/৩ টা স্কিলের একটা আলুভর্তা বানানো।
সারা বইতে তো আলুভর্তা নাই, না আছে বাকি ৯টা বইতে। তাইলে দক্ষতা বৃদ্ধিতে একদিনের একটা ব্যবহারিক সেশনকে অস্ত্র বানিয়ে এই অসুস্থ আন্দোলন কেন? তাদের বইতে তো কেয়ার গিভিং বা নার্সিং এর মতো স্কিলও বিদ্যমান। সেটা দেখেননা চোখে? আগামী বছরের অষ্টম নবমের বইতে অসুস্থদের / বৃদ্ধদের সেবা করা, জমির পর্চা, খতিয়ান বুঝা, অনলাইন থেকে জমি সংক্রান্ত কাজ করা, আর্থিক ব্যবস্থাপনা, বিনিয়োগসহ আরো বেশ কিছু স্কিল লক্ষ্য করলাম? এগুলো কি খারাপ?
বইতে কোন পড়া নাই :
বইতে কোন পড়া নাই। বাচ্চারা পড়ে না। দিন দিন পড়া ভুলে যাচ্ছে। সারারাত অ্যাসাইনমেন্ট করে। কাগজ কাটাকাটি, গুগলিং ইত্যাদি ইত্যাদি।
গত বছর বৃত্তি পাওয়া ছেলেটা সব পড়া ভুলে গেছে।
৬ মাসের ব্যবধানে যে ছেলেটা সব পড়া ভুলে যায়, তার বৃত্তি পাওয়ার দরকার কী ভাই?
কোন বইতে পড়া নাই মানে কি?
বইগুলো খুলে দেখছেন কোনদিন?
তবে এটা বলতে পারেন, আগের মতো নির্দিষ্ট কোন টপিক নিয়ে নির্দিষ্ট কোন আলোচনা নাই বইগুলোতে।
এই বিষয়টাতো শিক্ষার্থীদের জন্য অফুরন্ত শেখার দ্বার খুলে দিয়েছে।
আমার পর্যবেক্ষন মতে, বিজ্ঞান, গণিত বইগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের সাথে ক্লাসে আলোচনার জন্য যথেষ্ঠ রসদ রয়েছে।
আমরা তো বিষয়টিকে ভিন্নভাবেও ভাবতে পারি, তাইনা?
এতদিন শিক্ষার্থীরা গাণিতিক সূত্র মুখস্ত করতো, এখন গণিত বইগুলোতে সে সুত্রগুলো কীভাবে এলো, সেটা ব্যাখ্যা করেছে। আমার তো মনে হয়, এতে ছাত্র/ছাত্রীরা আরো সহজে গাণিতিক সুত্রের প্রয়োগ করতে পারবে।
এটা এক ধরণের ডিপ লার্নিং। কাজড় কাটাটাই চোখে পড়লো? আউটপুটটা দেখলেন না?
মুখস্ত করা :
মুখস্ত করা বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে। সব তো প্রাকটিক্যাল হয়না। মুখস্ত করার দরকার আছে ইত্যাদি….
কারিকুলাম কি সব কিছু মুখস্ত করা বাদ দিয়ে দিয়েছে? কারিকুলাম কি অ-আ-ক-খ নিজের মতো বানাইয়া লেখতে বলছে? কারিকুলাম কি বলছে এ প্লাস বি হোল স্কয়ার কে সৃজনশীল ভাবে যার যার ইচ্ছেমতো লেখো। নাকি বলেছে সুত্রটা মুখস্ত না করেও বুঝে বুঝে শেখা যায়।
Vocabulary কি বানাইতে বলছে? গ্রামার অংশ কি বানাইতে বলছে? বিজ্ঞান, ধর্ম কি বানাইতে বলছে? মুখস্ত বাদ দেওয়া হইছে পান কৈ?
কারিকুলাম তো মুখস্ত করা বাদ দিয়ে দেয় নাই। মুখস্ত করার প্রবণতাকে কমিয়েছে।
গ্রামার / ব্যাকরণ :
গ্রামার ব্যকরণ নাই। তো, সেটা শেখার দরকার কী?
আপনি যখন বাংলা ভাষায় কথা বলেন, তখন কোন কারক-বিভক্তি-সমাস ব্যবহার করেন? যে সকল ছাত্র/ছাত্রীরা ইংরেজীতে ভাল ফলাফল করেছে (90+) তাদের কয়জন ইংরেজিতে কথা বলতে সক্ষম?
গ্রামার আমরা তাহলে কেন শিখবো? পরীক্ষায় নম্বর পাওয়ার জন্যই তো? কোন ভাষা শেখার জন্য গ্রামার জানাটা কত জরুরী, সেটা জনার জন্য বিদেশে থাকেন এমন কারো সাথে আলোচনা করুন।
ভাষা শিখতে গ্রামার লাগেনা।
আর IELTS/SAT/GMAT/GRE ইত্যাদি? সেটা কি সবাই করে?
আর গ্রামার নাই, কথাটাও সঠিক নয়? যদি sentence, Parts of Speech, degree, tense & their structure, voice changing ইত্যাদি গ্রামারের অংশ হয়ে থাকে তাহলে আপনাদের চোখের চিকিৎসা আবশ্যক। formal/informal letter writing, dialogue, column matching, true/false, vocabulary বাদই দিলাম।
আর বিগত দিনগুলোতে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র/ছাত্রীরা তো গ্রামার ছাড়াই দিব্যি সিন/আনসিন প্যাসেজের উত্তর দিয়েছে। আনসিনের উপর তো চিঠিও লিখেছে না শিখেই। তো তখন আন্দোলন কোথায় ছিল আপনাদের?
দুই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা :
দুই ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থা বলকে কী বোঝাতে চাইছেন, সেটাই ক্ষুদ্র মাথায় ঢুকে নাই।
বাংলা মাধ্যম বনাম ইংরেজি মাধ্যম?
সাধারণ শিক্ষা বনাম কারিগরী শিক্ষা?
স্কুল কেন্দ্রিক শিক্ষা বনাম মাদ্রাসা শিক্ষা?
নাকি ষষ্ঠ/সপ্তম বনাম অষ্টম/নবম/দশম?
এটাতো আগামী বছরই এক হচ্ছে। বাকীগুলোতো পুরোনো সিস্টেম।
পরীক্ষা নাই :
পরীক্ষা নাই, তাই বাচ্চারা পড়ে না। দিন দিন পড়াশোনা ভুলে যাচ্ছে। কী দিচ্ছে? ত্রিভুজ চতুর্ভুজ ভং চং। ইউনিভার্সিটিকে কী এসব দিয়ে ভর্তি করাবে? ইত্যাদি…
এখন যে ছেলেটা ষষ্ঠতে তার ইউনিভার্সিটি যাইতে আরো ৬/৭ বছর। আপনাদের কি মনে হয় এতদিনে শুধু মাধ্যমিকের কারিকুলাম চেঞ্জ হচ্ছে / হবে?
অন্যগুলো বাদ যাবে? তা তো নয়। সবকিছুই কারিকুলামের সাথে খাপ খাইয়ে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হবে কারিকুলাম অনুযায়ী । যদি না হয়, তখন সেটা আন্দোলনের একটা ইস্যু হতে পারে।
কিন্তু পরীক্ষা নাই বলতে আপনারা কী বোঝেন? কেন মনে করেন পরীক্ষা নাই?
ষাণ্মাষিক পরীক্ষা তো ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। বার্ষিকও হবে। তাহলে পরীক্ষা নাই মানে কি?
ওহ! আগের মতো তিন ঘন্টা খাতা কলম দিয়ে তো লেখা হলো না। যুক্তিসঙ্গত কথা!
তার আগে পরীক্ষা কী সেটা বুঝি।
প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষা হচ্ছে একজন শিক্ষার্থী, নির্দিষ্ট একটা টাইম ফ্রেমে বা একটা নির্দিষ্ট পিরিয়ডে তার জন্য নির্ধারিত পাঠ্যক্রমের (Syllabus) কতটুকু অর্জন করতে পেরেছে তা যাচাই করা।
কোন এক সময় শিক্ষাক্রমের নির্দিস্ট পিরিয়ডের প্রান্তিক যোগ্যতা ছিল, কবি লেখকদের লেখা কবিতা মুখস্ত করতে পারা, রচনা, প্যারাগ্রাফ জানা, বিভিন্ন গাণিতিক সমস্যা সমাধান করা ইত্যাদি ইত্যাদি। শ্রেণি ও বিষয় অনুযায়ী আরো আরো যোগ্যতা। সেগুলো যাচাই করার প্রক্রিয়াও ছিল ভিন্ন। লিখিত পরীক্ষা ছিল।
এখন লিখিত পরীক্ষা একেবারেই নেই তা তো নয়। লিখিত আছে, ব্যবহারিক আছে, হাতে কলমে শিখছে। নিজে নিজে শিখছে।
এর চেয়ে বড় সুযোগ শিক্ষার্থীর জন্য আর কী হতে পারে? ঘরে বসে খাতা-কলমে আলু-পটলের ফর্দ তৈরী করা আর বাজারে গিয়ে বাস্তবে বাজার করা কি এক? খাতা কলমে tanA দিয়ে গাছের উচ্চতা বের করা আর বাস্তবে সেটা প্রয়োগ করে শেখা কি এক? খাতা-কলমে গুছিয়ে সুন্দর করে ত্রিভুজ-চতুর্ভুজ আকৃতির ক্ষেত্রফল বের করে উত্তর লেখা কি জরুরী? নাকি বাস্তবে সেটা প্রয়োগ করে সত্যিকার ক্ষেত্রফলটা বের করা জরুরী?
বর্তমান শিক্ষাক্রমের প্রান্তিক যোগ্যতাগুলোকে বিভিন্ন পারদর্শিতার সুচক আর আচরণিক সুচকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। প্রতিটি সুচককে আলাদা আলাদা মুল্যায়ন হচ্ছে।
যেমন (উদাহরণ স্বরূপ) ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা বিষয়ের পারদর্শিতার সূচকগুলো এরকম
** নিজের এবং অন্যের প্রয়োজন ও আবেগ বিবেচনায় নিয়ে যোগাযোগ করতে পারছে কি না?
** বাংলা ধ্বনি ও শব্দের প্রমিত উচ্চারণ করতে পারছে কি না?
** প্রমিত ভাষায় কথা বলতে পারছে কি না?
** লেখায় শব্দের অর্থবৈচিত্র্য বিবেচনায় নিতে পারছে কি না?
** বিভিন্ন ধরনের লেখা বিশ্লেষণ ও তৈরি করতে পারছে কি না?
(ষাণ্মাসিকের ট্রান্সক্রিপ্ট দেখুন)
বিষয়টা তো একই হলো। যদি মনে করি প্রতিটি সুচক এর নম্বর তিন। ত্রিভুজ – 3, বৃত্ত – 2, আর চতুর্ভুজ – 1। তাহলে কোন শিক্ষার্থী কত পেলো সেটা তো বের করা যায়, তাই না?
তাইলে মূল্যায়ন নাই কেমনে? প্রতিযোগীতা উঠিয়ে দিলো কেমনে?
আমরা বাংলা ভাষা কেন শিখবো? বাংলা বই কেন পড়বো? উপরের যোগ্যতাগুলোর জন্যই তো। আগে সেটা রচনা, অনুচ্ছেদ, কারক বিভক্তি সমাস দিয়ে পরীক্ষা দিয়ে যোগ্যাতার প্রমান দিতে হতো।
এখন সেটা বাস্তবে আচরণ কিংবা কথা বলে কিংবা লিখিত ভাবে দিতে হচ্ছে। যার ফলে সবগুলো টপিক লিখিত আকারে হচ্ছে না। তাই
পরীক্ষা পরীক্ষা ফিল হচ্ছেনা। কিন্তু, মুল্যায়ন ঠিকই হচ্ছে। (সব বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা সুচক আছে)
আগে ছিলো ১ম বিভাগ, ২য় বিভাগ, ৩য় বিভাগ
তারপর এলো এ গ্রেড, বি গ্রেড, সি গ্রেড।
এখন সেটা ত্রিভুজ, বৃত্ত চতুর্ভুজে পরিবর্তন হয়েছে।
হিসাব তো একই হলো। শুধুমাত্র বাহ্যিক চিহ্নগুলো পরিবর্তন হলো। ত্রিভুজ তো প্রথম সারিতেই রইলো।
রইলো বাকী প্রথম দ্বিতীয় প্রতিযোগীতা।
শিক্ষার্থীদের নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগীতা লাগিয়ে দেয়াটা কি খুবই দরকার?
আমাকে এ+ বা সবগুলোতে ত্রিভুজ পেতে হবে এমনটা হলে কি খুবই লস হয়ে যায়?
প্রয়োজন কি ছাত্রদের মাঝে এই মানষিক চাপের যে তাকে ফার্স্ট হতেই হবে?
দেশের প্রতিটি বিদ্যালয়ের মেধা তালিকা কি শুদ্ধ হয়? কোন অনিয়ম কি হয়না মেধাতালিকায়। মনে করি হয়না। তারপরেও যখন একই নম্বর দুই জনে পায়, তখনও কি একজনকে দ্বিতীয় করা হয় না?
ক্লাসের সবাই যদি ভালো হয়, তাহলেও কি সবাই প্রথম হয়? নাকি প্রথম হতে পারবে? এই মানষিকতা থেকে বেরিয়ে আসলে কি ছাত্রদের জন্য খুবই খারাপ হয়ে যাবে?
তার পাবলিক পরীক্ষার সার্টিফিকেটে কি ষষ্ঠতে প্রথম, সপ্তমে প্রথম লেখা থাকবে?
মোবাইলে আসক্তি :
স্যাররা বলে গুগল করে নেও। ইউটিউব দেখো। বাচ্চারা সারাদিন রাত মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে। দিন দিন তারা মোবাইলে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে… ……..
তথ্য জানার জন্য গুগল করার কথা কোন বইয়ের কোন অধ্যায়ে লেখা আছে?
যে সকল স্যাররা এরকম বলে তারা অবশ্যই ভুল বলে। কারিকুলোমে বলা নাই যে, ইউটিউব আর গুগল থেকে অ্যাসাইমেন্ট করতে হবে। শিক্ষক তাদের বুজিয়ে দিবেন কোন কোন অ্যাসাইনমেন্টের জন্য কোন ধরণের সোর্স ব্যবহার করবে। তাদের তথ্য পেতে সহযোগীতা করবেন। আমি যতটা জানি এটাই নিয়ম।
আর যদি কোন তথ্য খোজার প্রয়োজনে মোবাইল ব্যবহার করেই তাতে কি সে আসক্ত হয়ে গেল?
দেশে যখন নতুন যাদুর বাক্স টেলিভিশন আসলো তখনও সচেতন অভিভাবকেরা বাচ্চাদের টিভি থেকে দুরে রাখতো । অনেকে সামর্থ্য থাকার পরও তখন টিভি কিনে নাই বাড়িতে।
বাচ্চার পড়ালেখা ক্ষতি হবে বলে। এখন তো বাচ্চারা সকাল সন্ধ্যা টিভি দেখে। ক্ষতি হয়না তখন?
আমি বলছিনা তাকে মোবাইল দিন। সেটা আপনার ইচ্ছা। প্রয়োজনে তার যতটুকু প্রয়োজন তাকে ততটুকুই দিন। মোবাইল চালাইলেই আসক্ত হতে হবে কেন?
যুগের পরিবর্তনে প্রযুক্তির পরিবর্তন হচ্ছে, হবে। আগে টিভিটা আলমারিতে থাকতো, তারপর সেটা দেয়ালে, টেবিল/টি-টেবিলে আশ্রয় নিলো, এখন সেটা হাতে চলে এসেছে। ভবিষ্যতে সেটা আরো ছোট হয়ে যাবে। কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স, ন্যানো টেকনোলজির কল্যানে তখন পৃথিবীর যাবতীয় জ্ঞান থাকবে নখের ডগায়।
আপনি যেমন ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায়, প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে হাতে একটা স্মার্ট ফোন রাখেন। বা যুগের সাথে পরিবর্তনকে মানিয়ে নিয়ে রাখতে হচ্ছে, তেমনি কি ভবিষ্যতে প্রযুক্তি আরো উন্নত হবে না?
আপনি কি পারবেন হাতের স্মার্ট ফোনটাকে বাদ দিয়ে দিতে?
যতদিন এই পরিবর্তনকে মানিয়ে নিতে না পারবো ততদিন আমরা এন্ড্রয়েড বানাতে পারবোনা। এন্ডয়েড চালাইতেও অন্যের সাহায্য নিতে হবে বার বার।
আমাদের দেশের মেধাবীরা আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে স্বর্ণপদক পায়, রৌপ্য-ব্রোঞ্জ পায় ফি বছর। বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড, গণিত অলিম্পিয়াড, প্রোগ্রামিং কনটেস্টে প্রতি বছরই পদক পাচ্ছে। আগামীতে এ অর্জন দিন দিন বাড়বে। আমার বিশ্বাস, নতুন কারিকুলাম ছাত্র/ছাত্রীদের অফুরন্ত শেখার সুযোগ করে দিয়েছে।
চতুর্থ শিল্প বিল্পবের জন্য আমাদের তৈরী হতে হবে। প্রযুক্তির সাথে তাল মেলাতে হবে। প্রযুক্তির উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে হবে এখন থেকেই।
শিক্ষার্থীদের প্রোগ্রামিং, প্রবলেম সলভিং, ডাটা স্ট্রাকটার শেখা উচিত। একদিন এটা কাজে লাগবে। প্রযুক্তির পরির্বতনকে মেনে নিতে কষ্ট হলেও এটা মেনে নিতে হবে ভবিষ্যত পৃথিবীতে টিকে থাকতে।
সবাই ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার হয়না। বিসিএস ক্যাডার হয়না। সবার ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-ক্যাডার হওয়ার দরকারও নেই আমাদের। আমাদের গবেষকও দরকার। বিজ্ঞানীও দরকার। সৃজনশীল চিন্তা করতে সক্ষম
মস্তিস্কও দরকার। দরকার উদ্ভাবক। আমার বিশ্বাস, সরকার আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে চতুর্থ শিল্প বিল্পবের জন্য তৈরী করতে যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
সৃজনশীল পদ্ধতির সমস্যা কি :
গাইড বইগুলোর ছড়া-ছড়ি না থাকলে সৃজনশীল পদ্ধতির তেমন কোন সমস্যা ছিল বলে মনে করিনা। তাই বলে কোন সিস্টেমকে উন্নত করা যাবে না কেন? আগেরটাও সৃজনশীল ছিল। এখনকারটাও সৃজনশীল। পার্থক্য পরীক্ষা ব্যবস্থায়। আগেও মুখস্ত না করে বুজে পড়ার জন্য সিস্টেম তৈরী করা হয়েছিল। নোট-গাইডের কারণে সেটা পুরোপুরি সফল না হলেও ছাত্র-ছাত্রীদের সহজে নম্বর পাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এখন মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন করা হয়েছে বা হচ্চে এবং হবে । বর্তমানে শিক্ষার্থীরা আগের চেয়েও বেশী সৃজনশীল হবে বলে ধারণা করা যায়।
অনেকে বলেন, আমাদের দেশের জন্য এটা উপযুক্ত না।
মেনে নিলাম। তাই বলে কি যেমন আছি, তেমনই থাকবো? পরিবর্তনের চেষ্টা করবো না?
পাগল কারিকুলাম :
সবাই কারিকুলামের বিপক্ষে। কারণ কি? ছেলেমেয়ে আলুভর্তা শিখছে। কাটাকাটি শিখছে।
লেখাপড়া নাই। এগুলোর বয়ান আগে দেয়া হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে আপনারা কারিকুলামকে খারাপ বলছেন কারণ বইগুলোর শিখন কার্যক্রম কে ভুল মনে হচ্ছে বা মেনে নিতে পারছেন না।
কিন্তু, কারিকুলাম কি বলে, সেটা কি কখনো দেখছেন? বা জানেন?
বইগুলো মানে তো কারিকুলাম না?
কারিকুলাম হচ্ছে একটা সিস্টেম, একটা পদ্ধতি, পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা ব্যবস্থার রূপরেখা।
বই গুলো হচ্ছে সে ব্যবস্থার আলাদা আলাদা মডিউল।
বইগুলোর টপিকগুলো আরো স্মার্ট হওয়া প্রয়োজন হয়তো। হয়তো বইগুলোর পরিমার্জন দরকার।
তাই বলে বইয়ের দোষ তো কারিকুলামের ঘাড়ে চাপাতে পারি না আমরা।
মুল্যায়ন পদ্ধতিটাও হয়তো পরিমার্জন দরকার।
আমি “জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১” এর ১২৪ পৃষ্ঠার সম্পূর্ণ গাইডলাইনটি পড়েছি।
আমার মনে হয়, আপনারাও যদি এটি একবার পড়ার সুযোগ পান তাহলে আমার মতো আপনারাও এর বিপক্ষে
বলার প্রয়োজন থাকবেনা। এই নতুন কারিকুলাম ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কতটা প্রয়োজন তা বুঝতে পারবেন।
তখন হয়তো আমরা আমাদের আন্দোলনকে পরিবর্তন করবো, যদি সিস্টেম অনুযায়ী কারিকুলাম বাস্তবায়ন না হয়।
কিছু উৎসাহী শিক্ষকদের কারণে আলুভর্তা ভাইরাল হলো। আর কিছু অতি উৎসাহী মহল এতে উস্কানি দিলো। কিছু কিছু কারিকুলাম বিরোধী শিক্ষকদের অসহযোগীতা, আন্তরিকতার অভাবই অভিভাবকদের বিদ্রোহের কারণ।
কারিকুলাম কি বলছে দোকান থেকে দামী দামী জিনিষ কিনে সেটা দিয়ে মডেল তৈরী করতে হবে? অ্যাসাইনমেন্ট করতে হবে?
কিন্তু, প্রতিযোগীতার জন্য শিক্ষার্থীরা দামী থেকেও দামী মডেল তৈরী করছে। শিক্ষকরা নিরুৎসাহী করছেন না।
অবশ্য একটা সিস্টেম থেকে অন্যটাতে শিফট হতে সবারই কিছুটা সময় লাগবে। সে সময়টা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
সবশেষে আপনি কেন হতাশ?
আপনি আসলে কী চান?
বছর শেষে সন্তানের আনা ফার্স্ট, সেকেন্ড হওয়া ট্রান্সক্রিপ্ট। যেটা দেখে বা অন্যদের দেখিয়ে সুখ মেলে। তৃপ্তি মেলে। নাকি সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। সন্তানকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-বিসিএস ক্যাডার বানানো। বড় অফিসার বানানো? বিজ্ঞানী, গবেষক বানানো।
দেশের সবারেই কি ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার/বিসিএস ক্যাডার হওয়াটা জরুরী? আপনি কি জানেন বর্তমানে দেশে কত বেকারদের কত শতাংশ ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার?
মেনে নিলাম, সবার দরকার নাই। কিন্তু, আপনার দরকার আছে। আর এখন সরকার তথা বর্তমান কারিকুলাম আপনার সন্তানসহ পুরো দেশটাকে মেধাশুণ্য করে ফেলছে।
এখন যে ছেলেটা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে, দশ বছর পর সে গ্রাজুয়েট হবে। তখন দেশের জন্য যে বিসিএস ক্যাডারগুলো নিয়োগ করবে সরকার তাদের কি বিদেশ থেকে আমদানী করবে?
নাকি এই মেধাশুন্যরাই ক্যাডার হবে? এই মেধাশুন্যদের দিয়ে যদি সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারেন। তাতে আপনার সমস্যা কোথায়?
আপনার তো ক্যাডার হওয়া নিয়ে কথা। দশ বছর পর কি দেশের মেডিকেল কলেজগুলো বন্ধ হয়ে যাবে? বুয়েট চুয়েট? এই মেধাশুণ্যরাই তো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবে। তাইলে এই মেধাশুণ্য হতে সমস্যা কোথায়?
গত ৫/৬ বছর আগে আমার স্কুলে (প্রাইভেট স্কুল) এই ধরণের একটা কারিকুলাম শুরু করেছিলাম।
হয়তো বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক কারণে কন্টিনিউ করতে পারিনি। এই কারিকুলামটাই আমি উন্নত ৫০ টি দেশের কারিকুলাম স্টাডি করেই করেছিলাম।
আমি বিশ্বাস করি, এটা কার্যকর। এ পদ্ধতিতে কোন শিক্ষার্থী কোন কোন পয়েন্টে দুর্বল তা সহজে বের করা যায়। আমরা বইগুলোকে আরো গাঠনিক, আরো স্মার্ট, আরো ইফেক্টিভ চাই। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বইগুলোর সংস্কার চাই। বইগুলোতে অনেক জায়গায় ভুল আছে সংশোধনী দেবার পরও। যারা পুস্তত প্রণেতা তাদের কাছে আবেদন থাকবে, তারা যেন দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের আরো ভালোভাবে আমরা তৈরী করতে পারি, সেকথা সর্বোচ্চ বিবেচনা করে পুস্তকগুলো সংস্কার করবেন।
না বুঝে অন্যের উস্কানিতে নিজের সন্তানের ক্ষতি না করে, তাকে সহযোগীতা করুন।
নতুন কারিকুলামে অভ্যস্ত হতে দিন। শিক্ষকগণও আন্তরিকভাবে কারিকুলাম বাস্তবায়নে সকলের সাথে একসাথে কাজ করবেন বলে বিশ্বাস করি।
যদি ভেবে থাকেন আপনাদের আন্দোলনে কারিকুলাম বন্ধ হয়ে যাবে, তাহলে বলবো ভুল ভাবছেন। ৬ মাস ৯ মাস পরীক্ষা করে কারিকুলাম বন্ধ করা যায়না । করা হয় না। বন্ধ করলেও সেটার জন্য আমাদের আরো অন্তত বছর দশেক অপেক্ষা করতে হবে।
এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী মানুষের উস্কানিতে ক্ষেপেছেন। ক্ষতি কার হচ্ছে? আপনার সন্তানেরই।
সে-আগ্রহ হারাবে। তাকে নতুন পদ্ধতিতে অভ্যস্ত করান।
যারা ইংলিংশ মিডিয়ামে দেবার কথা ভাবছেন। দিতেই পারেন। বাচ্চা আপনার, সিদ্ধান্ত আপনার।
আর যদি স্কুলেই না পাঠান, তাহলে তো কথাই নাই।
সেক্ষেত্রে, আপনি আর আপনার বাচ্চা দুজনেই বেঁচে যাবেন, মেধাশুণ্য হবার হাত থেকে।
সবশেষে দালাল বলে আরেকটা আন্তুরিক গালি দেন। মীরজাফরও বলতে পারেন।
ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নেই।
(কাউকে বোঝানোর ক্ষমতা আমার নাই, যদি কেউ বুঝতে না চায়।)