জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রচন্ড ক্ষতিগ্রস্থ দেশ হিসেবে জাপান পরিচিত। অর্ধ শতাব্দীরও কম সময়ে একটা দেশ জিরো টু হিরো হতে পারে তার উদাহরণ হিসাবে জাপানের নাম উল্লেখ করা যুক্তিসঙ্গত কিনা জানিনা। তবে এটুকু বলতেই পারি, প্রযুক্তি, শিক্ষায়, বিনয়ে তারা অনেকখানি এগিয়ে। তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত কাটিয়ে উঠেও একটা অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ারে পরিণত হয়েছে।

জাপানি শিক্ষা ব্যবস্থায় মূলত: তিনটি স্তর বিদ্যমান।
১। এলিমেন্টারী স্বুল (৬ বছর / 1-6)
২। লোয়ার সেকেন্ডারী স্কুল (৩ বছর / 7-9)
৩। আপার সেকেন্ডারী স্কুল (৩ বছর / 10-12)

আপার সেকেন্ডারী শেষে,
২ বছর ফাউন্ডেশন + ২ বছর ব্যাচেলর
অথবা,
৪ বছর আন্ডারগ্রাজুয়েশন
২ বছর পোষ্ট গ্রাজুয়েশন
অথবা,
৬ বছর মেডিক্যাল

একাডেমিক বছর শুরু হয় ১ এপ্রিল থেকে।

প্রথম ৯ বছর অর্থাৎ এলিমেন্টারী ও লোয়ার সেকেন্ডারী শিক্ষা বাধ্যতামূলক।

এলিমেন্টারী স্কুলের আগে কিন্ডারগার্টেন লেভেল। তাদের মতে, কিন্ডারগার্টেন লোখাপড়ার জায়গা নয়। ওটা ডে-কেয়ার। এখানে তারা আচার ব্যাবহার, হাঁটা চলা, খাওয়া দাওয়া শিখে। আর ফুল, পাতা, পশু-পাখি চিনে। তাদের মতে, রাস্তায় হাটা, পার্কে হাটা, কোন শপিং সেন্টারে হাটার কিছু নিয়ম আছে, এমনকি এসকেলেটারে উঠা, লিফট ব্যাবহার করা এসব শেখা উচিত। কারণ সব যায়গার আলাদা আলাদা ভদ্রতা আছে। উদাহরণ, এসকেলেটারে ডান পাশে সরে দাড়ানো উচিত, যাতে যাদের দ্রুততা আছে তারা যেন বাম পাশ দিয়ে হেটে তাড়াতাড়ি নেমে যেতে পারে। কয়েকজন একসাথে ফুটপাথে হাটলে রাস্তা যেন ব্লক না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা, ওরা আবার ডিজেবলডদের প্রতি খুব সদয়। তাই তাদেরকে প্রাধান্য দিয়ে কিভাবে রাস্তায় বা বাসে ও ট্রেনে চলতে হয় এসব শেখানো হয়। এর সাথে আচরণ, বিভিন্ন রকম সম্ভাষণ, কোথায় কখন কোনটা ব্যাবহার করতে হয়।

এছাড়াও রাস্তা পার হওয়া, ট্রাফিক রুলস, পাবলিক ন্যুইসেন্স, পরিষ্কার পরিছন্নতা, সাতার শেখা, সাইকেল চালনা, হালকা শারিরীক কষরত বা ব্যায়াম, কিছু সাধারণ খেলাধুলা, এসবই শেখান হয়। খাতা কলমের শিক্ষা যেটা কিন্ডারগার্টেন এ শেখান হয় তা হল আঁকাআকি বা অঙ্কন। এটাতে জাপানীজরা এক্সপার্ট। অঙ্কনের সাথে সাথে তারা শিখে Visualization বা দৃশ্যায়ন। তারা যা কল্পনা করে তা যেন ছবিতে প্রকাশ করতে পারে। আর সেখান থেকেই এসেছে Emocon (Emotional Icon) যা আমরা মেসেঞ্জারে ব্যাবহার করি। এছাড়াও Gesture বা বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে কিছু বর্ণনা শেখানো হয়। আর একটা বাধ্যতামূলক শিক্ষা হচ্ছে অরিগ্যামি বা কাগজ দিয়ে বিভিন্ন জিনিষের যেমন পশু-পাখির মডেল বানানো।

এসব আমাদের কাছে হয়ত কোন শিক্ষা মনে হবে না, তবে তাদের মতে, এসব ওদের শিশুদের মন বিকাশের জন্য জরুরী। কারণ তারা চায় ওদের ছেলেমেয়েরা যেন সৃষ্টিশীল হয় এবং তারা নতুন কিছু সৃষ্টি করতে না পারলেও যা আছে তার যেন উন্নতি সাধন করতে পারে।


কিন্ডারগার্টেন লেভেলে সর্বপ্রথম যে তিনটি শব্দ এদের শেখানো হয় তা হল –
কননিচিওয়া (হ্যালো)

  • পরিচিত মানুষকে দেখা মাত্র ‘হ্যালো’ বলবে ।

আরিগাতোউ (ধন্যবাদ)

  • সমাজে বাস করতে হলে একে অপরকে উপকার করবে । তুমি যদি বিন্দুমাত্র কারো দ্বারা উপকৃত হও তাহলে ধন্যবাদ দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে ।

গোমেননাসাই (দুঃখিত)

  • মানুষ মাত্রই ভুল করে এবং সেই ভুলের জন্য ক্ষমা চাইবে ।

এগুলো যে স্কুলে শুধু মুখস্ত করানো হয় তা নয়। বাস্তবে শিক্ষকরা প্রোএক্টিভলি সুযোগ পেলেই এগুলো ব্যবহার করেন এবং করিয়ে ছাড়েন ।

এলিমেন্টারীর প্রথম তিন বছর ক্লাস ১-৩ পর্যন্ত আসলে কোন লেখাপড়া বা পরীক্ষা নাই। কিন্ডারগার্টেন এ যা শিখেছিল তারই কিছু উন্নত লেভেলের কাজ শেখান হয় এবং এর পাশাপাশি ওদের বর্ণমালা, কিছু বেসিক গণিত মানে যোগ, বিয়োগ, গুন ও ভাগ শেখান হয়।

কাপড় ধোয়া, থালা বাসন ধোয়া, গোছ গাছ করা, ঘর পরিষ্কার করা, নিজের জিনিষ নিজে করা, নিজে নিজে কাপড় পরা, জুতার ফিতা বাধা এসবের ধারণা দেওয়া হয় এবং এলিমেন্টারি স্কুলের প্রথম তিন বছর এসব প্রাকটিক্যালি শিখান হয়। যাতে প্রত্যেকে স্বাবলম্বী বা স্বনির্ভর হতে পারে।

এলিমেন্টারীর ছাত্র ছাত্রীরা স্কুলে একটি কোরাস গায় যার অর্থ —
“প্রতিটি শিশুই এক একটি ফুল,
তারা স্বতন্ত্র মহিমায় ভাস্বর।
গোলাপকে যেমন রজনীগন্ধার সঙ্গে তুলনা করা যাবে না,
তেমনি গাঁদার সঙ্গে শাপলার তুলনা চলে না।
তাই গোলাপকে গোলাপের মতোই প্রস্ফুটিত হতে দাও,
শাপলাকে শাপলার মতো।
প্রতিটি শিশুকে তার নিজস্ব রূপ, রস, গন্ধের সম্পূর্ণতায় বিকশিত হতে দাও!”
(আমি শিক্ষক-অভিভাবকদের কথাগুলো বোঝার জন্য অনুরোধ করবো)

মজার ব্যাপার হল এইসময় পর্যন্ত কোন বিদেশী ভাষার বর্ণমালা শেখান হয় না। খেলাধুলার ওনেক কসরত শেখান হয় এবং বলা বাহুল্য যে তাদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক খেলাধুলা এখন থেকেই শুরু হয়ে যায়।

প্রাথমিকে সাধারণত জাপানি ভাষা, গণিতবিদ্যা, ইতিহাস, শরীরচর্চা, সংগীত ও শিল্প ইত্যাদি শেখানো হয়। আসল পড়াশুনা শুরু হয় চতুর্থ ক্লাস থেকে। তবে শর্ত থাকে যে, শিক্ষার্থী যেকোন একটি খেলাধুলা এবং এর সাথে সাথে যে কোন একটি সাংস্কৃতিক বিষয়েও পারদর্শী হতে হবে। তার মানে হচ্ছে যে এলিমেন্টারি পর্যায় শেষ করে একজন শিক্ষার্থী তার জীবনের যেন একটা লক্ষ্য খুঁজে পায় যে, ভবিষ্যতে সে কোন ধরণের যোগ্যতা অর্জন করতে চায়।

বাচ্চাদের টয়লেট ক্লিনিংয়ের একটা বিশেষ দিক উল্লেখ না করলেই নয়- পুরাতন টুথব্রাশ দিয়ে ইউরিনাল, কমোডের কোনায় জমে থাকা ময়লাও পরিষ্কার করানো হয় যেন সে নিজে কোনোদিন টয়লেট অপরিচ্ছন্ন রেখে অর্থাৎ টয়লেট টিস্যু দিয়ে সব পরিষ্কার না করে টয়লেট ত্যাগ না করে।
ক্লাস টিচারদের তদারকিতেই সব কাজ তারা করে। শিক্ষক দেখবেন সব ঠিক মতো হলো কিনা, কিন্তু শিক্ষক নিজে হাত লাগাবেন না। যাতে শিশুর আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি তৈরি না হয়।

সারা বছর ৩ মাসে একবার করে (নির্দিষ্ট সময়ে না) সব বিষয়ে ক্লাস টেস্ট জাতীয় অভীক্ষা নেওয়া হয়। তাতে পাশ-ফেলে কিছুই যায় আসে না।
চতুর্থ থেকে নবম পর্যন্ত শুধুমাত্র শিক্ষার অগ্রগতি মূল্যায়ন করা হয়। রোল নম্বর বসানো হয় নামের অদ্যাক্ষর অনুযায়ী।

তারা এটা বিশ্বাস করেন যে, প্রথম ৩ বছরের স্কুলজীবনেই একজন শিশুর জ্ঞান বা শিক্ষার বিচার করা যায় না, বরং ভালো আচরণ এবং তাদের চরিত্র উন্নত করার শিক্ষা দিয়ে থাকে। শিশুদেরকে অন্য মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করা এবং প্রাণী ও প্রকৃতির প্রতি কোমল হওয়া শেখানো হয়। তারা কিভাবে উদার, সহনশীল এবং সহানুভূতিশীল হতে হয় তা শিখে। এছাড়াও বাচ্চারা চরিত্রের দৃঢ়তা, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং ন্যায়বিচারের মতো গুণাবলীর শিক্ষা পায় এলিমেন্টারীতেই।


লোয়ার সেকেন্ডারী পর্যায়েই শিক্ষার্থীদের ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার বা মাষ্টার্স, পি এইচ ডি করলেই যে সফল ব্যাক্তি হতে পারবে, অন্য কিছু করলে সফল হবে না এই ভূলটাই ভেঙ্গে দেওয়া হয়। শিক্ষা বলতে ওরা শুধু আর্টস, কমার্স বা সাইন্স বোঝে না। তাদেরকে এর চেয়েও অনেক বেশী কিছু বোঝানো হয়।

স্কুল সরকারী, বেসরকারী উভয়ই প্রচলিত। তবে প্রতিটি স্কুলই সাধারণত সর্বোচ্চ 20/25 মিনিটের হাঁটা দূরত্বে অবস্থিত। জাপানী ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে দলবেধে হেঁটে যেতে হয়। আর দল ঠিক করে দেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ। ইচ্ছা করলে কেউ কেউ তাদের সন্তানকে গাড়ি করে স্কুলে পৌঁছে দিতে পারে। তবে সাধারণত কেউ তা করেনা (কিছু কিছু নোটে মিডল স্কুল পর্যন্ত ছাত্রদের হেঁটে যাওয়া বাধ্যতামূলক বলে উল্লেখ পেয়েছি। অঞ্চল ভেদে তারতম্য আছে কিনা নিশ্চিত নই) ।

অনেক স্কুলে (সরকারী ও কিছু বেসরকারী) দুপুরে খাবার সরবরাহ করা হয়। নিজের খাবার নিজ হাতে প্লেটে নিতে হয়। শ্রেণি কক্ষে খাবার খেতে হয়। খাবার পর, কক্ষ পরিস্কার করার দায়িত্ব ছাত্রছাত্রীদের। তাছাড়া, ক্লাস শেষে শ্রেণি কক্ষ, সংশ্লিষ্ট বারান্দার ময়লা, ধুলো, ফ্লোর পরিস্কার করা তাদের প্রতিদিনের দায়িত্ব।

জাপানী শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের সুস্থ ও সুষম খাবার খাওয়া নিশ্চিত করার জন্য সর্বোত্তম চেষ্টা করা হয়। সরকারি প্রাথমিক ও জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয়গুলিতে, শিক্ষার্থীদের জন্য সাস্থ্যসম্মত লাঞ্চ সরবরাহ করা হয়। সব শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকদের সাথে শ্রেণীকক্ষে একসাথে বসে লাঞ্চ করে। এটি শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সহায়তা করে বলে তারা মনে করেন।

নবম শ্রেণি শেষ করে ভর্তি হতে হয়, আপার সেকেন্ডারীতে। ভর্তির জন্য তাদেরকে পরীক্ষা দিতে হয়। আর এ পরীক্ষাই হচ্ছে তাদের জীবনের প্রথম একাডেমিক পরীক্ষা (পরীক্ষা বলতে আমরা যা বুঝি)।

ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার আগেই মান যাচাই পরীক্ষা হয় যার যার নিজের জুনিয়র হাইস্কুলেই। শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে কর্মকর্তারা আসেন কেবল।
এই পরীক্ষার ফল দেখে কর্মকর্তারা নির্ধারণ করে দেন কোন ২টা স্কুলে এই শিক্ষার্থী সুযোগ করে নিতে পারবে। প্রথমে ১টি সরকারি, ১টি বেসরকারি স্কুলে পরীক্ষা দেবে। সুযোগ না হলে আরো ২টা। অর্থাৎ সর্বোচ্চ ৪টা (২টা সরকারি, ২টা প্রাইভেট) স্কুলে পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়ে যাবে।

জাপানে স্কুল উপস্থিতি হার প্রায় ৯৯.৯৯%। সম্ভবত আমাদের সবার জীবনে কমপক্ষে একবার হলেও স্কুল ফাঁকি দিয়েছি। জাপানী ছাত্ররা কখনো ক্লাস ফাঁকি দেয় না এবং স্কুলে যাওয়ার জন্য দেরি করে না। তাছাড়া, জাপানে প্রায় ৯১% ছাত্রছাত্রী রিপোর্ট করেছে যে, তারা কখনো কোন ক্লাস বা শিক্ষকের বক্তৃতা উপেক্ষা করেনি। কতগুলো দেশ এই ধরনের পরিসংখ্যান নিয়ে গর্ব করতে পারে আমার জানা নেই?

স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় স্কুলের সব শিশুকে ৪টি গ্রুপে ভাগ করা হয়। সবাইকে অংশগ্রহণ করতেই হবে। কিন্তু প্রতিটি ইভেন্টেই জয় পরাজয় গ্রুপ পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। ব্যক্তিগত অর্জন দিয়ে একজনকে আঙুল দিয়ে ‘ও সেরা’ ‘ও দুর্বল’ এমন ক্লাসিফিকেশনের সুযোগই থাকে না। স্কুলে যেন ছাত্রদের ভিতর ধনী গরীবের পার্থক্য না করতে পারে সেজন্য সজাগ দৃষ্টি রাখা হয়। এভাবে ছোট থেকেই টিমওয়ার্কে অভ্যস্ত করে তোলা হয় তাদের। যেন কর্মক্ষেত্রেও একজন দুর্বল হলে টিম জেতানোর স্বার্থে অন্যরা সাহায্য করবে, ভাববে কিভাবে তার ইম্প্রুভাইজেশন করা যায়। তারা নিজের জন্য কিছু করেনা। এই জন্যই হয়তো জাপানে একটি তথাকথিত ‘লিডার’ তৈরি হয় না। কিন্তু এরা সবাই এক একজন লিডার ।

জাপানে সাধারণত ছোট ছোট বাসা, জায়গা বাঁচাতে প্রচুর কলোনি প্যাটার্নের সারি সারি বাড়ি দেখা যায়। কিন্তু পার্কের পর পার্ক, স্কুলে মাঠের পর মাঠ। শিক্ষার্থীদের শারীরিক কাঠামো ছোট থেকেই মেদহীন, পেটানো ঝরঝরে, আলস্যবর্জিত করে তুলতে ছকে বাঁধা নিয়মেই শারীরিক কসরত ও এ জাতীয় কর্মকাণ্ড রুটিন বেঁধে করানো হয়। যা, তারা শতায়ু হয়েও মেনে চলে।